যাতনা কাহারে বলে !
হেপাটাইটিস বি এক রক্তবাহিত জীবাণু এবং সারা বিশ্বব্যাপী লিভার রোগের অন্যতম প্রধান কারণ| পৃথিবী জুড়ে প্রায় 30 কোটি মানুষ আক্রান্ত এবং এ সংখ্যা ক্রমবর্ধমান| ভারতবর্ষে গড়ে শতকরা 4 জন এই ভাইরাস বহন করে চলেছেন; অনেকে নিজের অজান্তেই | অতিরিক্ত সংক্রমণ প্রবণতা দেখা যায় তাদের যারা ইনজেকশন ড্রাগ এড্ডিক্ট, যাদের বহু যৌনসঙ্গী আছে আর যারা চিকিৎসা পরিষেবার সাথে যুক্ত|
2016 সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অঙ্গীকার করে সারা বিশ্ব থেকে 2030 সালের মধ্যে হেপাটাইটিস বি কে নির্মূল করার| আজ বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই জাতীয় হেপাটাইটিস বি দূরীকরণ প্রোগ্রাম চালু আছে| আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর যেহুতু মাত্র শতকরা দশ ভাগ তাদের সংক্রমণ সম্বন্ধে অবহিত, তাই আরো অধিক সংখ্যায় টেস্ট করার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে| এছাড়াও হেপাটাইটিস বি দূরীকরণ এর জন্য সর্ব স্তরের মানুষের ভ্যাকসিনেশন, চিকিৎসা পরিকাঠামোর উন্নয়ন, চিকিৎসার সর্বজনীক অধিকার এবং সরলীকৃত নির্দেশাবলী জরুরি পদক্ষেপ|
হেপাটাইটিস বি দূরীকরণের উদ্দেশ্যে কাজ করে চলেছেন অগণিত স্বাস্থ্যকর্মী, গবেষক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ| কিন্তু দুঃখের বিষয়, যাদের কথা ভেবে এতো কিছু সেই আক্রান্ত মানুষগুলো পড়ে আছেন বহু দূরে| তাদের আশা, আকাঙ্খা আর অধিকারের নিঃশব্দ বাণী পৌঁছচ্ছে না কারো কানে| এই অসহায়তা আর বঞ্চনার গুরুত্ব শুধু রুগীর সংখ্যা আর মৃতের হিসাব দিয়ে মাপা যাবে না| প্রতিটি মানুষের অভিজ্ঞতা ভিন্ন ও তাঁর নিজস্ব| আজ তাই সময় এসেছে এই আক্রান্ত মানুষগুলোর কথা শোনার|
সমাজবিদেরা আজ প্রধানত তিন ধরণের সমস্যার কথা উপলদ্ধি করছেন :
1. প্রাথমিক সমস্যা : যা আক্রান্ত ব্যক্তির মনোসামাজিক সমস্যা
2. আনুষঙ্গিক সমস্যা : যা আক্রান্ত ব্যক্তির প্রতি সামাজিক প্রতিক্রিয়ার ফলস্বরূপ
3. সুদূরপ্রসারী সমস্যা : এই সামাজিক প্রতিক্রয়া যে ক্ষতি বয়ে আনে
প্রাথমিক সমস্যার মধ্যে প্রথমেই পরে লিভার ক্যান্সার ও লিভার সিরোসিস এর ভয়| হেপাটাইটিস বি রোগ নির্ণয় এক অজানা আশংকায় ভাবিয়ে তোলে; আছে রোগের ক্রমবর্ধমানতা আর অকাল মৃত্যুর ভয়| গুগল ইউনিভার্সিটি তে রুগী হাতড়ে চলেন হেপাটাইটিস বি র তথ্যভান্ডার| আর যত বিদ্যে বাড়ে ততই বাড়ে ভয় ও আতঙ্ক| তথ্য আছে কিন্তু নেই এমন কোনো সার্চ ইঞ্জিন যা দেবে ভরসা| তাই আসে একাকিত্ব, হতাশা আর বাস্তব কে অস্বীকার করবার জেদ| দুশ্চিন্তা ও হতাশা আরো ডালপালা মেলে যখন একদিন সত্যিই রোগের লক্ষন দেখা দেয়|
এর সাথে যোগ হয় আর্থিক চিন্তা| নিয়মিত চিকিৎসা, ঘন ঘন কাজ কামাই, ব্যয়বহুল পরীক্ষা নিরীক্ষা; এসবের দাবি যে অন্তহীন| তার উপর পরিবারের বাকি সদস্যদের পরীক্ষা, তাদের ভ্যাকসিন দেওয়ার ব্যবস্থ্যা – সব তো আর ইন্সুরেন্স দেবে না| আর ভাইরাস ছড়ানোর ভয়| নিজের ই টানা লক্ষ্মণরেখায় গুমরে মরে| বিয়ে নয় সন্তান নয় | শুধুই তুমুল একাকিত্ব |
আনুষঙ্গিক সমস্যা গুলির দিকে এবার দৃষ্টিপাত করা যাক| এতো ঢাক পেটানো প্রচারের আলো তাও মানুষ এখনো ভেবে চলেছেন একসাথে খাবার খেলে, এক চেয়ার এ বসলে, হাত মেলালে, এক গাড়িতে চাপলে সংক্রমণ ছড়াবে| কেউ কেউ আবার ভাবছেন এ ব্যাটা বংশগত রোগে ভুগছে| মানুষের জ্ঞানের পরিধি বাড়লে তো এসব অবৈজ্ঞানিক চিন্তা থাকার কথা নয়| দুঃখের ব্যাপার হলো এ ব্যাপারে চীন এর হাইমেন শহরে এক সমীক্ষায় দেখা গেলো সম্পূর্ণ উল্টো ফল – যত জ্ঞান বাড়ছে তত বাড়ছে ছুৎমার্গতা| তাই শুধু তথ্য নয়, ভরসাটাও জরুরি| এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে পারতেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা| কিন্তু তারা নিজেরাই ভাইরাস এ আতংকিত হওয়ায় তাদের সদিচ্ছা রূপ পাচ্ছে না| সংক্রামিতর পরিবারের সকল সদস্যকেই ক্যারিয়ার ভেবে নিলে ভুল হচ্ছে|
কর্মস্থলে দিনরাত চলছে চাপা গুঞ্জন| আইন আছে অনেক কিন্তু তা ঠুঁটো জগন্নাথ| কোনো কোনো দেশ তো দেয় না প্রবেশের অধিকার |
আর তাই দিনের শেষে আসে নীরবতা, আসে একাকিত্ব | বৃহত্তর সমাজথেকে দূরে সরে যাওয়া | মাদুলি তাবিজ, তুক তাক আর জড়িবুটির অন্ধগলির খোঁজ চলতে থাকে | ধেয়ে আসে অপরাধবোধ|পাপের ভোগ না কর্মফল| নিস্তেজ মন ভাবে এ জীবন মূল্যহীন|
আজ 28শে জুলাই ওয়ার্ল্ড হেপাটাইটিস ডে তে আমরা যখন আলোকিত আলোচনাসভায় বসেছি, তখন আমাদের চেতনায় থাকুক এই মানুষ গুলোর না বলা কথা আর অজানা উপলদ্ধি| ওষুধ, পরীক্ষা আর ভ্যাকসিন এর সাথে প্রেসক্রিপশন এ জায়গা করে নিক ভালোবাসা, মমত্ব আর সহানুভূতি | গবেষকরা ফাঙ্কশনাল কিওর এর সাথে আবিষ্কার করুন ফাঙ্কশনালি প্রোডাকটিভ লাইফ কিভাবে বজায় রাখা যায়| সমাজকর্মীরা এগিয়ে আসুন সৎ পরামর্শ দিতে যাতে হেপাটাইটিস বি আক্রান্তরা বিষাদ কাটিয়ে যোগ দেন জীবনের মূলস্রোতে| সমাজবিদেরা আলোকপাত করুন মনোজগতের গহীন বনে; যে আলোর ছটায় দূর হয়ে যায় ভয় অস্থিরতা অনিশ্চয়তা| সর্বোপরি দেশচালকেরা নিয়ে আসুন বিশ্বাসের বাতাবরণ|
সবাইকে নিয়ে শুরু হোক নতুন ভোর!
Written by : Dr. Sanjay Banerjee